ড. কুল
পুরো ব্যবস্থাটা যিনি উদ্ভাবন করেছেন, ড. সাউদ আবদুল গানি, তিনি বিবিসিকে বলেছেন যে কাতার একটা উত্তরাধিকার তৈরি করতে চায়। ফুটবলাররা যে যার দেশে ফিরে যাবার পরেও এই উদ্ভাবনের সাথে যেন কাতারের নাম চিরকাল জড়িয়ে থাকে।
তিনি বলছেন, তার ভাষায় ''তাপমাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য" দিতে বহু বছর ধরে এই গবেষণার কাজ চালানো হয়েছে। এর মাধ্যমে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে যা সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের জন্য আরামদায়ক হবে। ২০১৯ সালে কাতারে ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় যোগ দেয়া অ্যাথলেট এবং ভক্তদের সাথে কথাবার্তা বলা হয়েছে, যা এই ওয়ার্ল্ড কাপে দর্শক ও খেলোয়াড়দের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টির নকশা তৈরিতে সাহায্য করেছে।
একজন খেলোয়াড়ের দৃষ্টিকোণ
বিবিসি কথা বলেছে কাতারের জাতীয় নারী ফুটবল দলের একজন ডিফেন্ডার, হাজার সালেহ-র সঙ্গে। ১১ বছর বয়স থেকে তিনি খেলেন। চরম আবহাওয়ার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্তরের খেলাধুলার চাহিদাগুলো সম্পর্কে তিনি পুরোই ওয়াকিবহাল। তিনি বলছেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল আর্দ্রতার মোকাবেলা।
গরম আমরা সহ্য করতে পারি, কিন্তু গরমের সাথে যখন আর্দ্রতা মেশে তখন পরিস্থিতি অনেক বেশি কঠিন হয় হাজার সালেহ
দুটি নতুন ভেন্যু, খালিফা এবং এডুকেশনাল সিটি স্টেডিয়াম, যেখানে নতুন এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থা বসানো হয়েছে, সেখানে খেলার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তার হয়েছে।
তিনি বলেন, নতুন ভেন্যুতে খেলার অভিজ্ঞতা একেবারে আলাদা - বিশেষ করে জুন মাসে, যখন কাতারে বছরের সবচেয়ে বেশি গরম পড়ে।
এই পদ্ধতি কি টেকসই?
কাতার ২০২২-এর আয়োজকরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, স্টেডিয়ামগুলো পুরোটা শীতল করতে যে জ্বালানি খরচ হবে, তা বাড়তি কোন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করবে না, কারণ এর জন্য বিদ্যুৎ আসবে নতুন বসানো সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে।
তবে কার্বন নিঃসরণের মাত্রার হেরফের না করে পুরো টুর্নামেন্ট আয়োজন নিশ্চিত করা অনেক সাহসী একটা আকাঙ্ক্ষা।
স্টেডিয়ামগুলো নির্মাণের সময় যে কার্বন নির্গত হয়েছে, যেটা ছিল 'নির্মাণ সংশ্লিষ্ট কার্বন', সেটাই ভেন্যুগুলোর সার্বিক কার্বন ব্যবহারের ৯০%। ভেন্যুগুলো তৈরিতে আবহাওয়ামণ্ডলে নির্গত হওয়া গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৮ লাখ টন। যেটা মার্কিন পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার নিঃসরণ গণনা মতে, একটা গাড়ি নিয়ে সারা বিশ্ব ৮০ হাজার বার প্রদক্ষিণ করলে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয় তার সমপরিমাণ।
স্টেডিয়ামগুলো ছাড়াও রয়েছে ওয়ার্ল্ড কাপ ভেন্যুগুলোতে যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত পরিবহণের প্রভাব, আরও আছে দেশটিতে ফুটবলপ্রেমীদের বিমানে উড়ে যাবার প্রভাব।
ফিফা বলছে, টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছে বেশ অল্প এলাকার ভেতরে। কাতারে ভেন্যুগুলো তৈরি করা হয়েছে কাছাকাছি দূরত্বে। ফলে একটা সাইট থেকে আরেকটা সাইটে যেতে যে কার্বন নির্গমন হবে, তা ২০১৮ সালে রাশিয়া আয়োজিত টুর্নামেন্টে নির্গত কার্বনের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম।
কাতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ইতোমধ্যেই যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়ে গেছে, অন্য ক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া হবে।
তবে সেটা তারা কীভাবে অর্জন করবে বলে আশা করছে তা এখন পর্যন্ত খুব পরিষ্কার নয়। ফিফা বলছে, বিশ্বকাপ আয়োজনের ফলে তারা যে কার্বন নিঃসরণ করেছে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে তারা ভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে - যার মধ্যে রয়েছে জ্বালানি সাশ্রয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার এবং সম্ভবত, গাছ লাগানো। তবে চূড়ান্ত পর্যায়ে কোন প্রকল্পগুলো বাছা হয়েছে তা নিশ্চিত করা হয়নি।
এ ধরনের প্রকল্প ব্যবহার করে কার্যকর কার্বন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। সম্প্রতি বিবিসির এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, কার্বন নির্গমনে ভারসাম্য আনতে বনায়নের বিষয়টি কাগজে কলমেই থেকে গেছে।
ফলে কাতার তার পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্য আসলেই অর্জন করেছে নাকি তাদের এই দাবি শুধুই ফাঁকা বুলি, তা সত্যিকার অর্থে বিচার করে দেখতে সময় লাগবে।
স্টেডিয়ামগুলো নির্মাণে ৩০ হাজার অভিবাসী শ্রমিক নিয়োগ করে কাতারকে মানবসম্পদের জন্য যে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে, তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা দেশটিকে সামাল দিতে হচ্ছে। বিপুল সংখ্যক শ্রমিক একাজ করতে গিয়ে হয় প্রাণ হারিয়েছে, নয় গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। এছাড়াও বাধ্যতামূলক শ্রম, অমানবিক কর্ম পরিবেশ, ঘিঞ্জি বাসস্থান, বেতন না দেয়া এবং পাসপোর্ট জব্দ করার নানা অভিযোগ উঠেছে।
কাতারের সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং জোর দিয়ে বলেছে যে ২০১৭ সাল থেকে তারা যেসব পদক্ষেপ চালু করেছে, তার মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত গরমে অভিবাসী শ্রমিকদের যাতে কাজ না করতে হয় সে বিষয়ে সুরক্ষা, তাদের কর্ম ঘণ্টা সীমিত রাখা এবং শ্রম শিবিরগুলোর অবস্থা উন্নত করা। তবে, শুধু ২০২১ সালেই বিশ্বকাপের সাথে জড়িত বিভিন্ন প্রকল্পে যারা কাজ করেছে, তাদের মধ্যে কাতারে মারা গেছে ৫০ জন শ্রমিক, গুরুতর আহত হয়েছে আরও ৫০০-এর বেশি। এই তথ্য সংগ্রহ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, আইএলও। মাঠের বাইরে এসব ক্ষেত্রে কাতারের রেকর্ড নজরে রাখা হয়েছে।