জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের ফোনের যেসব খনিজ পদার্থ সাহায্য করতে পারে
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী তেলের নেশা থেকে বিশ্ব কীভাবে বের হবে?
এর উত্তর আছে আপনার পকেটেই।
আমাদের ফোনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ ব্যবহার হয়- সেগুলো ঘর উষ্ণ রাখা ও পরিবহনে ব্যবহৃত উইন্ড এবং সোলার পাওয়ার ব্যাটারি তৈরির জন্যও প্রয়োজনীয়।
আপনার ফোনের ভেতরের চিত্র দেখতে নিচে স্ক্রল করুন এবং দেখুন এটি কোন কোন খনিজ পদার্থ দিয়ে তৈরি।
স্ক্রিন, মাইক্রোচিপ, ক্যাবল এবং ব্যাটারির মতো অংশগুলো প্রদর্শন করে একটি মোবাইল ফোনের প্রসারিত চিত্র।
যদি মোবাইল ফোনটি খুলে ফেলেন তবে এমনটাই দেখতে পাবেন।
এই সকল খনিজ আপনার মোবাইল ফোনকে সচল রাখে। এর ব্যাটারিতে থাকে নিকেল, লিথিয়াম এবং কোবাল্ট।
এই খনিজ বা মিনারেলগুলো আমাদের বিদ্যুৎচালিত যানবাহন, ঘর ও অফিসকে সচল রাখতে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন কমানোর কর্মসূচি 'নেট জিরো' অজর্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ফোন সংযোগকারী তার, সার্কিটবোর্ড, ব্যাটারি এবং কেসিং হাইলাইট করা হয়েছে।
ফোনের অন্যান্য অংশেও নিকেল আছে। মেডিকেল যন্ত্রপাতিসহ নানা পণ্যেও এটি ব্যবহার করা হয়।
ফোনের ব্যাটারি হাইলাইট করা হয়েছে।
লিথিয়াম এমন একটি খনিজ যা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসায় 'মুড স্টেবিলাইজার' ড্রাগ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।
ফোনের ব্যাটারি হাইলাইট করা হয়েছে।
কোবাল্ট মূলত রিচার্জেবল ব্যাটারিতে ব্যবহৃত হয়। গয়নাতেও এর ব্যবহার আছে।
কেন আমরা ব্যাটারির দিকে নজর দিচ্ছি? কারণ এতে ব্যবহৃত এই তিনটি খনিজ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
বিদ্যুৎচালিত যানবাহনে ব্যবহৃত ব্যাটারির কারণে গুরুত্বপূর্ণ খনিজগুলোর উচ্চ চাহিদা তৈরি হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) বলছে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী বিক্রি হওয়া প্রতি ২৫টি নতুন গাড়ির মধ্যে একটি ছিল বিদ্যুৎচালিত। এই বছর, এটি হবে পাঁচটির মধ্যে একটি।
পরিবেশবান্ধব উৎস থেকে চার্জ করা বিদ্যুৎচালিত যানবাহন অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত ইঞ্জিনের তুলনায় চার ভাগ বা তারও কম দূষণ করে, বলছে আইইএ।
সোলার প্যানেল, বিদ্যুৎচালিত যানবাহন এবং উইন্ড টারবাইনের মতো সবুজ প্রযুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজগুলোর প্রয়োজন হবে।
আগামী ২০ বছরে বিদ্যুৎচালিত যানবাহন এবং গ্রিড স্টোরেজের বড় ধরনের বিকাশ ঘটবে, তাই এই খনিজগুলো আমাদের প্রচুর প্রয়োজন হবে।
গুরুত্বপূর্ণ খনিজগুলোর চাহিদার দিকে নজর দেয়া যাক
আমরা নেট জিরোর লক্ষ্যে এগোলে চাহিদা কীভাবে পরিবর্তিত হবে? (নেট জিরো অর্থ হলো বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের মোট পরিমাণ আর বৃদ্ধি না করা।)
এই খনিটি আমাদের প্রয়োজনীয় খনিজগুলোর পরিমাণকে নির্দেশ করছে (স্কেল পরিমাপে আঁকা হয়নি)।
গত বছর বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত নিকেলের পরিমাণ: ৩২০০ কিলোটন (যা ৩.২ মিলিয়ন কারের ভরের সমান)
২০৩০ সালের মধ্যে নেট জিরো অর্জনে আমাদের প্রায় ৫,৭০০ কিলোটন নিকেল প্রয়োজন।
কিন্তু বর্তমানে নিকেলের সরবরাহ মাত্র 4,140 কিলোটন- যা ২০৩০ সালের নেট জিরো চাহিদার চেয়ে বেশ কম।
লিথিয়াম ও কোবাল্টের দিকে নজর দেয়া যাক।
লিথিয়াম: ২০২২ সালে চাহিদা, ১৪৬ কিলোটন; ২০৩০ সালের মধ্যে নেট জিরো নির্গমন, ৭০২ কিলোটন; ২০৩০ সালের মধ্যে প্রত্যাশিত সরবরাহ, ৪২০ কিলোটন।
আমাদের অবশ্যই ২০৩০ সালের মধ্যে লিথিয়ামের সরবরাহ বাড়াতে হবে যদি আমরা গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করতে চাই।
কোবাল্ট: ২০২২ সালে চাহিদা, ২০০ কিলোটন; ২০৩০ সালের মধ্যে নেট জিরো নির্গমন, ৩৪৬ কিলোটন; ২০৩০ সালের মধ্যে প্রত্যাশিত সরবরাহ, ৩১৪ কিলোটন
যদি আমরা বৈশ্বিক উষ্ণতাকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করতে চাই তবে ২০৩০ সালের মধ্যে কোবাল্টের সরবরাহ বাড়াতে হবে ।
চলুন দেখা যাক পৃথিবীর কোথায় কোথায় এই খনিজগুলো পাওয়া যায়।
২০২২ সালে, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং রাশিয়া গোটা বিশ্বের খননকৃত নিকেলের দুই-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করেছিল।
লিথিয়ামের ৯১ শতাংশই সরবরাহ করে অস্ট্রেলিয়া, চিলি এবং চীন।
গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র (ডিআর কঙ্গো), অস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের কোবাল্ট সরবরাহের ৮২% খনন করে।
ডি আর কঙ্গো, কোবাল্ট: ৭৪%; ইন্দোনেশিয়া, নিকেল ৪৯%; অস্ট্রেলিয়া, লিথিয়াম ৪৭%
গুরুত্বপূর্ণ খনিজ খনন গুটিকয়েক দেশে কেন্দ্রীভূত। প্রতিটি খনিজের শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশগুলো হলো:
এই খনিজগুলির প্রক্রিয়াজাতকরণ কোথায় হয়?
খননের চেয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ ভৌগলিকভাবে আরও অধিক কেন্দ্রীভূত।
চীন, কোবাল্ট ৭৪%, লিথিয়াম ৬৫%; ইন্দোনেশিয়া, নিকেল ৪৩%।
চীন লিথিয়াম এবং কোবাল্টের একটি বড় অংশ প্রক্রিয়াজাত করে, যেখানে ইন্দোনেশিয়া সবচেয়ে বেশি নিকেল প্রক্রিয়াজাত করে।
চীন, কোবাল্ট ৭৪%, লিথিয়াম ৬৫%, নিকেল ১৭%।
পৃথিবীর বিরল উপাদানগুলির ৯০% চীন প্রক্রিয়াজাত করে, যা আধুনিক প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়।
ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে যে অত্যাবশ্যকীয় সম্পদের সরবরাহ এবং বাণিজ্য রুটে যথাযথভাবে বৈচিত্র্য আনতে ব্যর্থ হলে তা বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে।
টিম গোল্ড, আইইএ
চিলির একটি লিথিয়াম খনিতে মাইনিং মেশিনে লবণের উপজাত দ্রব্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
চিলির লিথিয়াম খনি
গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সরবরাহের পথে বাধাগুলো কী?
একটি সাধারণ খনি প্রস্তুত হতে ১৫ বছর বা তার বেশি সময় লাগতে পারে এবং আমরা ২০৩০ সাল থেকে সাত বছরেরও কম দূরত্বে আছি।
কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের কোবাল্ট খনিতে শোচনীয় পরিস্থিতিতে কাজ করছেন একজন নারী৷
কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের কোবাল্ট খনি
নতুন মজুদ পাওয়া গেলে তা আহরণে রাস্তার মতো অবকাঠামো সুবিধা নাও থাকতে পারে।
নতুন খনিগুলি অনিরাপদ হতে পারে। তাই ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত উত্তোলন নিশ্চিত করতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা দরকার।
গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে কোবাল্ট এবং তামার খনিতে উৎপাদন সম্প্রসারণের ফলে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করার মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে, ব্যাটারির পুনর্ব্যবহার দরকার হবে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন বেশিরভাগ বিদ্যুৎচালিত যানের ব্যাটারি ২০ বছরের মধ্যে পরিবর্তন করতে হবে।
যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন বর্তমানে ব্যাটারির উপকরণের অর্ধেকেরও কম পুনর্ব্যবহার করা যায়।
কিন্তু তারা বলছে, ৮০ শতাংশের বেশি ব্যাটারি পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে পুনর্ব্যবহারযোগ্য হতে পারে।
পুনর্ব্যবহার সহজ করার জন্য আমাদের ব্যাটারি প্রস্তুত প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল অ্যান্ডারসন।
আমরা যে পরিমাণ ব্যাটারি তৈরি করছি তা সম্পূর্ণরূপে পুনর্ব্যবহার করতে পারি না। আমরা যত ব্যাটারি বানাতে চাই তা তৈরি করার জন্য এখনই পর্যাপ্ত খনিজ উত্তোলন করা হচ্ছে না।
যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল অ্যান্ডারসন।